রিট পিটিশন ৮৭৬৯/২০১০
বাংলাদেশ ন্যাশনাল উইমেন লইয়ার স এসোসিয়েশন (BNWLA) বনাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য (২০১১)
বাংলাদেশ ন্যাশনাল উইমেন লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (BNWLA) বনাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্য (২০১১) মামলাটি বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন (PIL) হিসেবে দায়ের করা হয়। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি ((BNWLA), দেশের একটি প্রথম সারির নারীর অধিকার সংস্থা, ইভ-টিজিং এর ক্রমবর্ধমান ঘটনাগুলোর প্রতিরোধে আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়েছিল। এই মামলাটি বাংলাদেশে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির স্থাপন করেছে। আদালত ইভ-টিজিং কে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে নারীদের সুরক্ষার জন্য শক্তিশালী আইনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। আদালতের নির্দেশনাগুলো আইনগত ও সামাজিক সংস্কার উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্ব বহন করে।, যা পরবর্তীতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও নীতিগত পরিবর্তন আনতে সহায়তা করেছে। তবে, নারীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রয়োজন এই পদক্ষেপগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন। আর এটি অনেকাংশে নির্ভর করে আইনের প্রয়োগ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা, সামাজিক পরিবর্তন এবং আপোষহীন ও সক্রিয় শাসনব্যবস্থার উপর।
যেমন করে এই মামলা আদালতে এলো
২০০৯-২০১০ সালের পর থেকেই ইভ-টিজিংএকটা সামাজিক মহামারী হিসেবে নিজেকে প্রকাশিত করে এবং এর ফলে অনেক ভুক্তভোগী মারাত্মক মানসিক আঘাতের শিকার হয়। এদের অনেকে সামাজিক ভাবে একঘরে হওয়ার ফলে অন্তিম রাস্তা হিসেবে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বিশেষত, কয়েকটি ঘটনা যেখানে কিশোরী,তরুণী এবং বিভিন্ন বয়সের নারীরা নিরবচ্ছিন্ন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এই ঘটনাগুলো মামলাটিকে আরও জোরালো করে তুলেছিল এবং স্বাক্ষ্য হিসেবে আদালতের কাছে তুলে ধরা হয়েছিল।
আদালতে BNWLA ইভ-টিজিং এর সঠিক সংজ্ঞার অভাবকে তুলে ধরে। তারা যুক্তি দেয় যে,ইভ-টিজিং কোন হাস্যরসাত্নক আচরণ নয় বরং এটি একটি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার রূপ। এই ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭,২৮(২),৩১,৩২ এর আইনের দৃষ্টিতে সমতার অধিকার,লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্যের নিষেধাজ্ঞা, আইনের সুরক্ষা ও জীবনের অধিকার এবং একজন নারীর জীবনের অধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারগুলো লঙ্ঘন করে। সরকার নারীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করার সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা বহন করে, বিশেষ করেCEDAW (নারীদের প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ সনদ)-এর অধীনে, যা বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে।
এছাড়াও তারা আরো উল্লেখ করে কিভাবে আইন-প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা একপ্রকার দণ্ডহীন সংস্কৃতি গড়ে তুলছে এবং কঠোর আইনি বিধান ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অভাবে দোষীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। সরকার পক্ষ ক্রমবর্ধমান ইভ-টিজিং নামক সামাজিক ব্যাধি নিবারনের গুরুত্বকে স্বীকার করে এবং দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ২০৯,৩৫৪ এবং ৫০৯ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে, ২০০০ এর ১০ ধারা কে উল্লেখ করে যার অধীনে যৌন হয়রানির অপরাধের উল্লেখ আছে। সরকার পক্ষ আরো বলে যে, বিদ্যমান আইনী কাঠামোর দ্বারাই এই সব অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব এবং বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচারাভিযানের মাধ্যমে হয়রানি প্রতিরোধ ও লিঙ্গ সংবেদনশীলতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
বাংলাদেশ হাইকোর্ট BNWLA-র পক্ষে রায় দেন এবং ইভ-টিজিং কে একটি গুরুতর যৌন হয়রানি ও নারীর সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের স্বীকৃতি দেন। এই মামলার বিচারকদ্বয় মোহাম্মদ ইম্মান আলী ও শেখ হাসান আরিফ বাদী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী ফাহিমা নাসরীনের সাহসিকতার প্রশংসা করে এবং মন্তব্য করেন যে, ‘যৌন হয়রানি থেকে সুরক্ষা এবং শিক্ষালাভ ও মর্যাদার সাথে কাজ করার অধিকার সর্বজনস্বীকৃত মৌলিক মানবাধিকার।‘
আদালত রিট আবেদনকারীর বিদ্যমান আইনের সংস্কার এবং ইভ-টিজিং এবং অন্যান্য সম পর্যায়ের অপরাধকে নির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করে এবং সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করে। নারী ও শিশু নির্যাদন দমন আইন, ২০০০ এর ধারা ১০(ক) এর সংস্কার এর মাধ্যমে বিদ্যমান যৌন হয়রানির সংজ্ঞায় ইভ-টিজিং এর মতো হাস্যরসের আড়ালে অপমানজনক মন্তব্য এবং আচরণ ছাড়াও স্টকিং এর মতো আচরণকে সংযুক্ত করে।
এছাড়াওআদালত ইভ-টিজং প্রতিরোধে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করেনঃ
সাংবিধানিক আইন
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭,২৮(২),৩১,৩২ অনুচ্ছেদ
তথ্যসূত্র
রিট পিটিশন ৪৪৯৫/২০০৯
অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন দোলন এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এর আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টে এই মামলার শুনানি হয়।
বংলাদেশে স্বতন্ত্রভাবে ধর্ম পালন,চলাফেরা এবং নিজের মতামত প্রকাশের অধিকার সংবিধান দ্বারা সংরক্ষিত। ২০১০ সালের ৮ এপ্রিল, বাংলাদেশ হাই কোর্ট রায় ঘোষণা দেন যে,হিজাব পরা কিংবা না পরা একজন নারীর ব্যাক্তিগত পছন্দ এবং সরকারি কর্মস্থলে নারীদের জন্য পর্দা বাধ্যতামূলক নয়। এই মামলায় সংবিধানের ২৭, ৩১, ৩২ ৩৯ অণুচ্ছেদ লঙ্ঘনের অভিযোগ আদালত আমলে নেন। এ প্রসঙ্গে বিচারক সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং সৈয়দা আফসার জাহান বলেছেন- “ বাংলাদেশে এমন কোনো প্রচলিত প্রথা নেই যা নারীদের মাথা ঢেকে রাখতে বাধ্য করে।সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, নারীদের এই প্রথা মানতে বাধ্য করার চেষ্টা দেখা গেছে, কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়েই নয় বরং সরকারি এবং বেসরকারি কর্মস্থলেও।’’বিচারকরা আরও বলেন যে, এই মামলা প্রমাণ করে যে, পাবলিক স্থান, স্কুল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য শিক্ষা কার্যক্রমে নারীদের এবং মেয়েদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
যেমন করে এই মামলা আদালতে এলো
২৮ জুন ২০০৯ সালে ‘দৈনিক সমকাল’ পত্রিকার ৯ নম্বর পাতায় একটা খবর প্রকাশিত হয়। জনাব আরিফ আহমেদ, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার,জনসম্মুখে পর্দা না করার ( হিজাব না পরা) জন্য কুড়িগ্রাম উপজেলার আত্নরাম বিশ্বাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সুলতানা আরজুমান বানু সম্পর্কে অত্যন্ত লজ্জাজনক মন্তব্য করে ( তাকে বে*া বলে গালিগালাজ করা হয়)।এই অপমান সহ্য করতে না পেরে আরজুমান বানু সেই মুর্হুততেই ঘটনাস্থলে অজ্ঞান হয়ে যান। তিনি বিগত ১৯ বছর ধরে শিক্ষকতার সাথে জড়িত, এমন মন্তব্য তার অনুভূতিকে প্রবলভাবে নাড়া দেয় ও সে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। যার ফলে তাকে ৭ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়।পরবর্তীতে সংবাদ মাধ্যম কর্মকর্তা আরিফ আহমেদ কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সে তাদের সাথেও খারাপ আচরণ করে।
সংবাদপত্রে এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর, এডভোকেট শাহাবুদ্দিন দোলন সরকারি কর্মকর্তার এমন স্বেচ্ছাচারিতা এবং রূঢ় আচরণের প্রতিবাদে আদালতে রিট করেন।পরবর্তীতে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) কো-পিটিশনার হিসেবে যোগদান করেন।আদালত এই রিটে রুল নিসি জারি করে।
আদালতের নোটিশের পর, প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের ডেপুটি ডিরেক্টর এর অধীনে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ২৮ জুন ২০০৯ সালের প্রকাশিত খবরটি সত্য, তবে কমিটির প্রধান এবং জনাব আরিফের পক্ষের আইনজীবী এই যুক্তি দেয় যে, গত ২৫ জুন ২০০৯ এ যা ঘটিত হয়েছে তা সম্পুর্ণ অনিচ্ছাকৃত ঘটনা এবং জনাব আরিফ এর জন্য আদালত ও আরজুমান বানুর নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। আরজুমান বানুও আদালতে জনাব আরিফকে ক্ষমা করে দেন, এবং ২০১০ সালের জানুয়ারিতে আদালত মামলাটি বন্ধ করে দেয়।
শাহাবুদ্দিন দোলন ও কো-পিটিশনার আদালতে এই যুক্তি দেয় যে,সরকারি কর্মকতার এমন আচরণ যে শুধু নারীদের প্রতি সহিংসতা এবং বৈষম্যমূলক আচরণকেই প্ররোচনা দেয় তা না বরং কর্মক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ‘ড্রেস কোড’ সংবিধান ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে।
মানবাধিকার সংগঠন এবং নাগরিক সমাজ এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে কারণ এটি নারীদের ব্যাক্তিস্বাধীনতা ও অধিকারকে সুরক্ষা প্রদান করে।
সাংবিধানিক আইন
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭, ৩১, ৩২ ৩৯ অণুচ্ছেদ
তথ্যসূত্র
Copyright © 2023 Aynerkotha.com - All Rights Reserved.