হিন্দু পারিবারিক আইন বলতে বিবাহ, ভরণপোষণ ও বৈবাহিক সম্পর্ক হতে উদ্ভূত অন্যান্য বিষয়, উত্তরাধিকার, দান, উইল, দত্তক, নাবালকের তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্ব সম্পকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনুসৃত ধর্মীয় আইন বুঝায়। এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দু আইন আইনসভা কর্তৃক একাধিকবার পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়েছে। ঐ সকল রাষ্ট্রীয় আইনও এখন হিন্দু আইনের অংশ।
হিন্দু আইনের আনুষ্ঠানিক উৎস হিসেবে বৈদিক যুগের ঐশী বাণীসমূহ (শ্রুতি বা বেদ) পরবর্তীতে বস্তুগত উৎস যেমন স্মৃতি, মন্তব্য, প্রা, বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত ও লিখিত আইনে রূপ লাভ করেছে। তবে জীবন, সমাজ ও প্রকৃতির পরিবর্তনশীল বস্তুগত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঋষী, মুনী ও পন্ডিতের লিখনীতে ঐশী বাণীর ব্যাখ্যায়ও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
সংশ্লিষ্ট আইন: হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন (২০১২), The Hindu Widow’s Re-marriage Act (1856), The Hindu Disposition of Property Act (1916), The Hindu Inheritance (Removal of Disabilities) Act ( 1928 ), The Hindu Law of Inheritance (Amendment) Act (1929 ), The Hindu Women’s Right to Property Act (1937), The Hindu Women’s Rights to Property (Extension to Agricultural Land) Act (1943), The Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act (1946), The Hindu Marriage Disabilities Removal Act (1946), The Special Marriage Act (1872), The Succession Act (1925), The Child Marriage Restraint Act (1929), The Dowry Prohibition Act (1980).
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সম্পন্ন ও হিন্দু শাস্ত্র মোতাবেক প্রচলিত প্রথা ও রীতি অনুযায়ী অনুমোদিত বিবাহকে হিন্দু আইনে বিবাহ গণ্য করা হয়।
পরিবর্তনশীল সমাজের প্রয়োজনে এবং বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের সার্বজনীন ধারণাকে সামনে রেখে, বাংলাদেশ আইন কমিশন ২০১০-২০১১ সালে হিন্দু পারিবারিক আইন বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করে । এই গবেষণা প্রতিবেদনে হিন্দু পারিবারিক আইনের বর্তমান অবস্থা, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, সংস্কারের গ্রহণযোগ্যতা, প্রতিবন্ধকতা ও সংস্কারের পক্ষের এবং বিপক্ষের ব্যাক্তি বর্গের যুক্তিগুলো তুলে ধরে হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে তথ্য উপাত্ত, বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন ছাড়াও হিন্দু জনগোষ্ঠীর মতামত সংগ্রহ করা হয়। মতামত দিয়েছেন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী’র ২৫০ জন সুশীল সমাজের হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যাক্তিবর্গ । পাঠকের জন্য বর্তমানে প্রচলিত আইনের পাশাপাশি জরিপে প্রকাশিত মতামত প্রকাশ করা হয়েছে। আইন কমিশনের সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি দেখুন এইখানে
হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নয়। হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন (২০১২) এ নিবন্ধন আবশ্যিক না করে স্বেচ্ছামুলক করা হয়েছে।
জনমত জরীপ : আইন কমিশনের প্রশ্নমালা
হিন্দু বিবাহের নিবন্ধন প্রয়োজন আছে কিনা?
হ্যাঁ: ৯১%
না: ৮.৬%
মন্তব্য নেই: ০.৪%
প্রচলিত হিন্দু আইন অনুযায়ী প্রত্যেক হিন্দু পুরুষ তার স্ত্রী, অপ্রাপ্তবয়স্ক পুত্র, অবিবাহিত কন্যা এবং বৃদ্ধ পিতামাতাকে ভরণপোষণ করতে আইনত বাধ্য।
বাংলাদেশে প্রচলিত সনাতনী হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমোদন নেই। সকল ধর্মীয় ও জাগতিক কার্যসাধনের জন্য স্বামী স্ত্রীর বন্ধন অবিচ্ছেদ্য বলে ধরা হয়। একান্তই স্বামীর সাথে বসবাসের উপায় না থাকলে বিবাহিত নারীর পৃথক বসবাস ও ভরণপোষনের জন্য আইন আছে যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রচলিত হিন্দু আইনে বহুবিবাহ অনুমোদিত। অর্থাৎ বহুবিবাহ ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিতে অবৈধ নয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনেও শাস্তিযোগ্য কোন অপরাধ নয়।
প্রথাগত আইন অনুযায়ী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ যা অসবর্ণ বিবাহ নামে পরিচিত তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রচলিত হিন্দু আইনে কেবলমাত্র হিন্দু পুরুষ পুত্র সন্তান দত্তক নিতে পারে। স্ত্রীরা স্বামীর সম্মতিতে দত্তক নিতে পারে।
জনমত জরিপ : আইন কমিশনের প্রশ্নমালা
হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ ও পুণবির্বাহের সুযোগ থাকতে পারে কি?
হ্যাঁ: ৮০% না: ১৫% মন্তব্য নেই: ০.৫%
হিন্দু আইনে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ করা যেতে পারে কিনা?
হ্যাঁ: ৮২% না: ১৫% মন্তব্য নেই: ০.৩%
ভিন্ন গোত্রের মধ্যে হিন্দু বিবাহ হতে পারে কিনা?
হ্যাঁ: ৭৯% না: ১২% মন্তব্য নেই: ৯%
কন্যা শিশুকে দত্তক নেয়া যেতে পারে কিনা?
হ্যাঁ: ৮৯% না: ৯% মন্তব্য নেই ০.২%
স্বামীর ন্যায় স্ত্রীদের দত্তক নেয়ার অধিকার থাকা উচিত কিনা?
হ্যাঁ: ৮৬% না: ১১% মন্তব্য নেই: ০.৩%
অবিবাহিত মহিলারা দত্তক নিতে পারবে কিনা
হ্যাঁ: ৮৩% না: ৯% মন্তব্য নেই: ৮%
বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু দায়ভাগ আইন অনুযায়ী স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৫ জন নারী উত্তরাধিকারী হচ্ছে বিধবা, কন্যা, মাতা, পিতার মাতা, পিতার পিতার মাতা। নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে তারা সম্পত্তি ভোগের অধিকার পায়। এরূপ সম্পত্তির অধিকার widow’s estate হিসেবে পরিচিত যদিও বিধবা ছাড়াও অন্যান্যরা এই অধিকার পেতে পারে। এই প্রকার অধিকারে তারা কেবলমাত্র জীবনসত্বে সম্পত্তি ভোগের অধিকার পায় অর্থাৎ জীবন অবসানের সাথে সাথে এই সম্পত্তি পূর্ব-মৃত ব্যক্তির পুরুষ উত্তরাধিকারীর নিকট চলে যায়। সীমিত কিছু ক্ষেত্র ছাড়া (legal necessity) এই সম্পত্তি হস্তান্তর করার অধিকার বিধবা মহিলা উত্তরাধিকারীদের নেই।
হিন্দু কন্যা পুত্রের উপস্থিতিতে সম্পত্তির অধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়। যদি পুত্র না থাকে তবে অবিবাহিতা কন্যা এবং পুত্রবতী কন্যারা জীবনস্বত্বে সম্পত্তির অধিকার পায়। অন্যদিকে বন্ধ্যা, বিবাহিতা কন্যা বা বিধবা কন্যা এবং কন্যা জš§দানকারী কন্যাগণ সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। অর্থ্যাৎ কন্যার অধিকার নির্ভর করবে পুত্র থাকা বা না থাকার উপর।
প্রথাগত হিন্দু আইনে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, কিছু রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও অসতী নারীগণ সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। বাংলাদেশে আইনের সাহায্যে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধিতার কারণে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবার নিয়ম রদ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বসবাসকারী শুধুমাত্র মিতক্ষরা মতাবলম্বীদের জন্য এই আইন প্রযোজ্য।
জনমত জরিপ : আইন কমিশনের প্রশ্নমালা
জীবন স্বত্বের পরিবর্তে নারীগণ সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার পেতে পারে কিনা?
হ্যাঁ ৮২% না ১১% মন্তব্য নেই ৭%
উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীরা সম্পত্তির অধিকার পেতে পারে কিনা?
হ্যাঁ ৮৬% না ১০% মন্তব্য নেই ৪%
শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধীদের সম্পত্তির অধিকার থাকা যৌক্তিক কিনা?
হ্যাঁ: ৮৪.৫% না ৯% মন্তব্য নেই ৬.৫%
প্রচলিত হিন্দু আইন অনুযায়ী প্রত্যেক হিন্দু পুরুষ তার স্ত্রী, অপ্রাপ্তবয়স্ক পুত্র, অবিবাহিত কন্যা এবং বৃদ্ধ পিতামাতাকে ভরণপোষণ করতে আইনত বাধ্য।
অভিভাকত্বের ক্ষেত্রে প্রচলিত হিন্দু আইনে নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণকে ক্রমানুসারে নাবালকের অভিভাবক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে :
১। স্বাভাবিক অভিভাবক হিসাবে পিতা
২। পিতার অবর্তমানে পিতা কর্তৃক উইল দ্বারা নিযুক্ত অভিভাবক
৩। উইল দ্বারা কোন অভিভাবক নিযুক্ত না হলে মাতা
৪। পিতা মাতা বা নিযুক্ত অভিভাবকের অবর্তমানে আদালত কর্তৃক নিযুক্তি অভিভাবক। এ ক্ষেত্রে আদালত পিতৃপক্ষের নিকটতম পুরুষ আত্মীয়কে প্রাধান্য দিবে এবং উক্তরূপ পুরুষ আত্মীয়ের অবর্তমানে মাতৃপক্ষের নিকটতম পুরুষ আত্মীয়কে প্রাধান্য দিবে। তবে পিতা কোন কারণে অভিভাবক নিযুক্তির অনুপোযুক্ত গণ্য হলে বর্তমানে আদালত অভিভাবক নিযুক্তির ক্ষেত্রে সন্তানের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে আদেশ প্রদান করছেন।
জনমত জরিপ : আইন কমিশনের প্রশ্নমালা
হিন্দু আইনে অভিভাকত্বের ক্ষেত্রে পিতা ও মাতার সমান অধিকার থাকা উচিত কিনা?
হ্যাঁ ৯৬% না ৩% মন্তব্য নেই ১%
আর্থিকভাবে সচ্ছল মহিলাদের তার সন্তানদের দায়িত্ব নেয়ার আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকার দরকার আছে কিনা?
হ্যাঁ: ৭১.৬% না: ১৬% মন্তব্য নেই ১১.৪%
সন্তানের স্বার্থ বিবেচনায় অভিভাকত্ব নির্ণয় করার আইন করা যেতে পারে কিনা?
হ্যাঁ: ৮৬% না: ৮.২%মন্তব্য নেই:: ৬.৮%